ফোন +৮৮০১৭১১২৬৭৫৩১
ইমেইল : [email protected]
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা
কাঁকন বিবির সংসার ভাংলো
সিঁথির সিঁদুর হারালো হরিদাসী
– কবি শামসুর রাহমান
এমন লাখো কাঁকন বিবির সংসার আর হরিদাসীর সিঁথীর সিঁদুরের বিনিময়ে অর্জিত ভুখন্ডের নাম বাংলাদেশ। তিরিশ লাখ শহীদ আর দশ লক্ষ মায়ের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ যে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ডের জন্ম দিয়েছিলো আজ সেই ভূখণ্ড তার ৪৮তম বছর পূর্ণ করলো। বাঙ্গালী জাতির গৌরবান্বিত অধ্যায়, জাতির জনকের আজন্ম লালিত স্বপ্ন “স্বাধীনতা”, আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের পথে রক্ত ঢেলে দেয়া সেই সকল বীর যোদ্ধাদের জন্যে নিরন্তর বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাঙালি জাতি তথা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় ইংরেজ শাসনের নামে ঊপনিবেশিক শোষন, লুন্ঠিত হয় মানবতা। ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে চলা শোষনের বিরুদ্ধে একসময় প্রতিবাদে ফুসে ওঠে আপামর জনতা। তারই ফলশ্রুতিতে, দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্রের। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বর্তমান বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে যুক্ত হয় পাকিস্তানের সাথে। সৌহার্দ্য ও সমঅধিকারের আশায় যাত্রা শুরু হলেও, বাঙালি জাতি আবার সেই ঊপনিবেশিক শাসনের কবলে পতিত হয়। চাকরি, শিক্ষা এমনকি ভাষার নামে এই জাতির উপড় চালানো হয় অমানবিক অত্যাচার। বাঙালি তখন অনুধাবন করে, তাদের মুক্তির একমাত্র পথ নিজেদের স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ড। শুরু হয় এক নতুন স্বপ্নের পথে চলা, এক নতুন লক্ষ্য অর্জনের প্রস্তুতি।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। এই শোষন আর বঞ্চনা থেকেই বাঙালির ভিতরে পুঞ্জিভূত হয় ক্ষোভ, যা পরবর্তীতে রূপ নেয় স্বাধিকার আন্দোলনে।
বাঙালির পুঞ্জিভুত ক্ষোভ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিনত হয় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পরে। এই নির্বাচনের পরেই বদলে যেতে থাকে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু’জন প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সরকার গঠনের পরিবর্তে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘোষনা করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২রা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত হয় “অসহযোগ আন্দোলন”। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, পূর্ব পাকিস্তানে এক ছায়া সরকারের অধীনে পরিচালিত হতে থাকে। এরই মাঝে ২রা মার্চ বাঙালি জাতি পায় তার জাতীয় পতাকা যা উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে। জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত তখন সারা বাংলা, বাঙালির চোখে তখন স্বাধীনতার নেশা।
৭০এর নির্বাচনের পরে ইয়াহিয়া খানের সামনে দুইটি পথ খোলা ছিলঃ
এক, নির্বাচিত দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর।
দুই, সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পুর্ব পাকিস্তানের জনগনের ন্যায্য দাবি ভুলুন্ঠিত করা।
ইয়াহিয়া খান দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করলেন। শুরু হলো আলোচনার নামে কালক্ষেপন ও পূর্ব পাকিস্তানের উপড় আঘাত হানার প্রস্তুতি। প্রস্তুতি পর্বের সময়ের জন্যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বেছে নিলো সাজানোর আলোচনার ফাঁদ।
১লা মার্চ, অন্যান্য দিনের মতো পুর্ব পাকিস্তানে সেদিনটিও অতিবাহিত হচ্ছিলো। কিন্তু আকস্মিক খবর এলো, প্রেসিডেন্ট পূর্ব নির্ধারিত ৩রা মার্চের জাতীয় অধিবেশন বাতিল করেছেন। মূহুর্তে ফেটে পড়লো জনতা। জনশূন্য হয়ে পড়লো অফিস আদালত, রাস্তাঘাট। জনতা হাতে বাঁশের লাঠি, হকিষ্টিক এমনকি পাতা ছাড়া নারিকেলের ঢেগা নিয়ে নেমে এলো রাস্তায়। বাংলার আপামর জন সাধারণের মনে স্বাধীন বাংলার যে আবছা প্রতিচ্ছবি ছিলো, সেদিন তা বাস্তব চিত্র লাভ করে। এটাই ছিলো, ২৫দিন ব্যাপী গণ বিক্ষোভের সূচনা।
২রা মার্চ ঢাকার ও পরদিন সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিক্ষোভ ঠেকাতে অপারগ হয়ে পড়ায় সন্ধ্যা ৭টার পরে দেশে সান্ধ্য আইন জারি ও সেনা মোতায়েন করা হয়।
৩রা মার্চ, টহলরত সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে কয়েকজন নিরস্ত্র বাঙালি মারা গেল কিন্তু বাঙালি দ্বিগুন তেজে রুখে দাঁড়ালে সামরিক জান্তা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। সেনাবাহিনী ছাউনিতে ফিরে গেলে ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সেদিন থেকে বঙ্গবন্ধুর সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত লাগাতার হরতাল ঘোষনা করেন। সেনাবাহিনীর খাদ্য ও অন্যান্য রসদ বন্ধ করে দেয়া হলে, সেনা ছাউনিও ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করতে শুরু করে।
ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার, ৭ই মার্চ ভোর বেলা থেকেই বাংলাদেশের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু এই বাড়িটিতে মিছিল সহকারে আসতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। সকলের এক দাবি, আজ স্বাধীনতার ঘোষনা চাই। বিকালে যখন জনসভায় জাতির পিতা উপস্থিত হলেন তখন জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত রেসকোর্স ময়দান। জাতির পিতা তার সেদিনের সেই ১৯ মিনিটের ভাষনে বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। জনগনের দাবি সত্বেও, রক্তপাতের আশঙ্কায় তিনি এড়িয়ে গেলেন স্বাধীনতার ঘোষনা। কিন্তু সেদিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার তর্জনী হেলনে মুহুর্তে বাংলার এক একটি ঘর পরিনত হয়ে উঠলো এক একটি দুর্গে।
৮ই মার্চ হতে ২৪ মার্চ দিনগুলোতে যথারীতি হরতাল পালিত হতে থাকে আর দুপুর ২টার পর বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও খোলা স্থানে চলতে থাকে সভা, মিছিল-মিটিং। ৮ই মার্চ জনসাধারণের দুর্ভোগ রোধ করার লক্ষ্যে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি অতিপ্র্যোজনীয় দপ্তরগুলো খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ দপ্তর গুলোকে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন যোগাযোগ সাবলীল রাখতে। ১৫ই মার্চ থেকে আইন অমান্য আন্দোলন আরও জোরদার করা হলো। পরিস্থিতি এমন হলো যে, পূর্ব বাংলার পুর শাসনযন্ত্র আওয়ামীলীগের নির্দেশে চলতে লাগলো।
অন্যদিকে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা চরম আঘাতের প্রস্তুতি হিসাবে ঢাকায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে নিয়োগ দেয় বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে। লাহোরে ভারতীয় বিমান ছিনতাই ঘটনার জের ধরে পশ্চিম পাকিস্তান হতে সীমান্ত সুরক্ষার নামে হাজির করা হতে থাকে বিপুল সেনা। ভারতের সাথে উত্তেজনাকর ও ক্রমঅবনতিশীল সম্পর্কের অজুহাতে, সেনাবাহিনীকে রাখা হলো সতর্ক অবস্থায়। বেলুচিস্তান রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ও বিপুল সমর উপকরণ জাহাজ ভরে আনার নির্দেশ দেয়া হলো। “এম ভি সোয়াত” শ্রীলংকা হয়ে চট্টগ্রাম আসার জন্যে প্রস্তুত ছিলো।
পরবর্তী কয়েকদিন, বিমানবাহিনীর সি-১৩০ বিমান বিভিন্ন সেনাদল ও আরু বিপুল সমর উপকরন নিয়ে পুর্ব পাকিস্থানে পাড়ি জমাতে থাকে অতি সঙ্গোপনে এবং গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি ইউনিটগুলোকে বদলি করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এছাড়াও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার সাথে আলোচনা করে সেনা স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়। করাচি বিমান বন্দরের হজ্ব টার্মিনাল যা হজ্ব মৌসুম ছাড়া থাকে প্রায় অচল থাকে তা আকস্মিক সামরিক তৎপরতায় মুখর হয়ে ওঠে। ২৪ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা শ্রীলংকা হয়ে ৬০০০ মাইলের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ১২০০০ এর অধিক সেনা বহন করে নিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তানে। শ্রীলংকার কতৃপক্ষ কোনো অভিযোগ করতে পারে নি কারন বিমানগুলো টিকিট কাটা সামরিক ও বেসামরিক যাত্রী পরিবহনের ভান করতো। সবক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হয়েছিলো কঠোর গোপনীয়তা।
নৌবাহিনীতেও আকস্মিক ব্যাপক বদলি শুরু হলো। তখন নৌবাহিনীর জাহাজগুলোতে শতকরা ৭০ ভাগ নাবিক ছিল বাঙালি। দ্রুততার সাথে তাদের স্থান দখল করে নিলো অবাঙ্গালি নৌসেনারা। বাঙ্গালি বিমান সেনাদের অন্যকাজের দ্বায়িত্তে বহাল করা হলো তড়িৎ আদেশে। টর্পেডোবাহী নৌবহর জরুরি আদেশে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের ঊদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। সব মিলিয়ে বাঙালি নিধণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো অতি গোপনীয়তার মধ্যে। বাঙ্গালি সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন দ্বায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো কাশ্মীর কিংবা অন্য কোথাও। তারপরেও তাদের রাখা হলো সর্বোচ্চ নজরদারির ভিতর। জেনারেল ইয়াহিয়া খান খুব ধূর্ত সেনানায়কের পরিচয় দিলেন। রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে পূর্বপাকিস্তানে সামরিক শক্তি দ্বিগুন করে ফেললো। এখন শুধু অপেক্ষা উপযুক্ত সময়ের।
ঘনিয়ে এলো সেই কালোরাত ২৫ মার্চ, ১৯৭১। নিরস্ত্র বাঙ্গালি নিধণযজ্ঞের সামরিক নাম দেয়া হলো “অপারেশন সার্চলাইট”। এদিন সন্ধ্যার কিছু আগে প্রেসিডেন্ট অপারেশনের নির্দেশ দিয়ে পাড়ি জমায় করাচির উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে এগারটার দিকে সামরিক বাহিনী খবর পায়, প্রেসিডেন্ট নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে পৌছেছেন। ঠিক তারপরেই শুরু হয় নারকীয় ধ্বংসলীলা। প্রথম প্রহরেই গ্রেফতার করা হয় জাতিরজনক শেখ মুজিবর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাড়ি থেকে। এই গ্রেফতার অপারেশনের নাম দেয়া হয় “অপারেশন বিগ বার্ড”।
এরপর শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান নামক নিরস্ত্র বাঙ্গালি নিধন অভিযান। পূর্বপ্রস্তুতিসহ পাকিস্তানি সেনারা ঝাপিয়ে পড়ে পিলখানায় ই.পি.আর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। প্রস্তুতি না থাকা স্বত্বেও বাঙ্গালি সেনাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে তারা। এছাড়া আক্রমন চালানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। নির্বিচারে হত্যা করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের গন কবর দেয়া হয় অথবা হলের ছাদে পচনের জন্যে রেখে দেয়া হয়।
শাখারিবাজার এলাকা ঘিরে হত্যা করা হয় ৮ হাজারের বেশি বেসামরিক জনতা যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু এবং নারী। ঢাকার আকাশ বাতাস বারুদের গন্ধে ও পলায়নপর মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে। এমন হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় সারাদেশে যা চলে পরবর্তী ৪৮ ঘন্টা জুড়ে। এরপর সারাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে সামরিক জান্তা। শুরু হয় বর্বর নির্যাতন, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণের মত পৈশাচিক কর্মকান্ড। তাদের সাথে যুক্ত হয় এদেশি কিছু দালাল যাদের নামকরণ করা হয় রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস নামে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, গ্রেফতারের পূর্বে ওয়্যারলেস যোগে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে যান, যা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেই ঘোষনা পাঠ করেন। শুরু হয়, বাঙালির স্বাধীকার লড়ার, মানুষের ন্যায় বাঁচার লড়াই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এমন এক লড়াই যেখানে যুক্ত হয়েছিলো শ্রেনি পেশা ভেদে সকল স্তরের জনগন। সামরিক বাহিনীর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন, নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। দেশপ্রেমের এক জলন্ত উদাহরন আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দিন আহমেদ সহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ গা ঢাকা দিয়ে হাজারু চড়াই ঊতরাই পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হলেন ভারতের সীমান্তে। বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ পলায়নপর জনগন ভারতে ইতোমধ্যে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ভারত সরকার কালবিলম্ব না করে এই বিপুল জনগনকে আশ্রয় দিয়ে শরনার্থি হিসাবে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে যতটা সম্ভব।
তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতে প্রবেশ করে দেখা করেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। সহযোগিতার আবেদন জানান অসহায় বাঙালির পক্ষ থেকে। এখানেও বঙ্গবন্ধু রেখে গেছেন অপরিসীম বিচক্ষনতার পরিচয়। আগে থেকেই তিনি ভারত সরকারের সাথে আলাপ করে রেখেছিলেন, যদি কখনো এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে যেন সাহায্য পাওয়া যায়। এখন শুধু দরকার ছিলো একটি সরকারের, যাদের তত্ত্বাবধায়নে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে, তাজউদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। চুয়াডাঙ্গার মেহেরপুরের বৌদ্ধনাথ তলায় এই সরকার শপথ গ্রহন করে এবং সেই স্থানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। একারণে এই সরকার মুজিবনগর সরকার নামেও অধিক পরিচিত।
এরই মাঝে জনতার ঢল নামে ভারত সীমান্তে। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে যুবক এবং সমর্থ সকলকে পাঠানো হয় ট্রেনিং দেবার জন্যে। শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। পুর্ব-পাকিস্তান সেনা বাহিনীর কিছু অফিসার এবং ভারতীয় সেনা নৌ ও গোয়ান্দা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলতে থাকে ট্রেনিং। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। ই.পি.আর, পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা পূর্ব-পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানদের নিয়ে গঠিত হয় কয়েকটি ব্রিগেড। তাদের সাথে সমানে কাধ কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে সদ্য ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা। যাদের অনেকের কিছুদিন আগ পর্যন্ত অস্ত্র সম্পর্কে ছিল না কোনো ধারনা। দেশের সাধারন খেটে খাওয়া মানুষেরা অসিম সাহিসিকতার সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধিন বাংলাদেশের পতাকা।
সরকারিভাবে মুক্তিবাহিনী দুইভাগে বিভক্ত ছিল। ১। নিয়মিত বাহিনী ও ২। অনিয়মিত বাহিনী
ই.পি.আর, পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা পূর্ব-পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল নিয়মিত বাহিনী। আর অনিয়মিত বাহিনী, সরকারি ভাবে যাদের নাম ছিল গণবাহিনী বা এফ এফ (ফ্রিডম ফাইটার) গঠিত হয়েছিল বেসামরিক জনগণদের নিয়ে। যাদের প্রশিক্ষনের মেয়াদকাল ছিল মাত্র দুই সপ্তাহ। দুই সপ্তাহ ট্রনিং দিয়ে এফ এফ দের পাঠানো হতো যার যার এলাকায় গেরিলা ওয়ারফেয়ারের উদ্দেশ্যে। এত সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছিল আমাদের বীর যোদ্ধাগণ। কারণ তাদের চোখে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন, বুকে ছিলো আগাধ দেশপ্রেম। বেঁচে থাকাকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন আগামী প্রজন্মকে এক খন্ড স্বাধীন ভূখন্ড উপহার দেবে বলে।
একদিকে চলতে থাকে সামরিক যুদ্ধ, অন্যদিকে মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধিরূপে চালাতে থাকে কূটনৈতিক তৎপরতা। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব মতামত গঠনের উদ্দেশ্যে ঈন্দিরা গান্দী ভ্রমন করে বিভিন্ন দেশ।
পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের মানুষের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজন করন। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। কনসার্টের শুরুতে বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরে ‘বাংলা ধুন’ নামে একটা পরিবেশনা করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরু রবিশঙ্কর। আর শেষে নিজের লেখা ও সুরে ৪০ হাজার মানুষের সামনে জর্জ হ্যারিসন গাইলেন,
‘বন্ধু আমার এল একদিন
চোখ ভরা তার শুধু হাহাকার
বলল কেবল সহায়তা চাই
বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার
বেদনা যদিবা না-ও থাকে তবু
জানি আমি, কিছু করতেই হবে
সকলের কাছে মিনতি জানাই
আজ আমি তাই
কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’
(অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ)
কাঁদলেন, কাঁদালেন আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরীতে অপরিসীম ভূমিকা রাখলেন দুই প্রান্তের দুই সংগীতজ্ঞ।
নভেম্বরের মধ্যভাগ ১৯৭১, বাংলাদেশের অকুতোভয় যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পলায়নপর হয়ে একের পর এক ঘাঁটি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই উপায়অন্ত না দেখে পশ্চিম পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়ে বসে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে। উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে যুদ্ধকে বিশ্ব পরিমন্ডলে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসাবে তুলে ধরা। পাকিস্তান অভিযোগ তুলেছিলো ভারত পাকিস্তানের অখন্ডতা ভেঙে দিতে কতিপয় দুস্কৃতিকারীকে সামরিক সাহায্য প্রদান করছে। পাকিস্তানের এই প্রয়াস কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখে যখন আমেরিকা জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলে কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশ্ববাসীর কাছে এই যুদ্ধের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে ততদিনে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে এবং ভারতের সাথে এক সময় উপযোগী চুক্তি করে। চুক্তিটি ছিলো, কোনো রাষ্ট্র যদি ভারতের সার্বভৌমত্ত্বের জন্যে হুমকি হয়ে দারায় তাহলে সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের পাশে সামরিক সাহায্য নিয়ে উপস্থিত হবে। সোভিয়েত রাশিয়া তাদের কথা রেখেছিল অকৃত্রিম বন্ধুর মতো। এতকিছুর পরেও আমেরিকা যখন তাদের সপ্তম নৌবহর ভারত উপকন্ঠে পাঠায় তখন সোভিয়েত নৌবহর রওনা হয়েছিলো তাদের প্রতিরোধ করতে।
সবমিলিয়ে, এই যুদ্ধ তখন হয়ে ওঠে বিশ্বমোড়লদের মাথা ব্যাথার কারণ। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয় নি ভারতে। ততক্ষনে, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড বীরবিক্রমে ঢুকে পড়েছে রাজধানী ঢাকায়। সারা বিশ্বে একত্র প্রচারিত হতে শুরু করলো “ঢাকা হ্যাজ ফলেন”। বিশ্বে মানচিত্রে জন্ম নিল এক নতুন দেশ, আমার বাংলাদেশ। তিরিশ লক্ষ শহীদ, দশ লক্ষ মায়ের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আত্মপ্রকাশ করলো আমার মাতৃভূমি। পূরণ হলো বাঙ্গালির জাতির জনকের আজন্ম লালিত স্বপ্ন যার জন্যে পুরো যৌবন যিনি কাটিয়েছে রাজপথে আর কারাগারে।
পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী পরাজয় বরণ করলো, যৌথবাহিনীর কমান্ডের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করল ঠিকই কিন্তু তার আগে তাদের দোসর আল-শামস বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার এক ঘৃন্য চক্রান্ত বাস্তবায়ন করলো। ১৪ ডিসেম্বর পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করলো এদেশের বুদ্ধিজীবীদের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমি এতোই বিস্তৃত যে, তা এক পাতায় লিখে শেষ করা অসম্ভব। লন্ডন টাইমস ১৯৭১ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছিলো, “যদি রক্ত হয় স্বাধীনতার সর্ব্বোচ দাম,তাহলে বাংলাদেশ সর্ব্বোচ দামেই স্বাধীনতাটা কিনেছে “।
এমন অকাতরে বুকের তাজা রক্ত আর কোনো জাতি বিলিয়েছে বলে জানা নেই। শিল্পী আব্দুল লতিফের গান বলে দেয় বাকি সব কথাঃ
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়,
দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি
জানা আছে জগৎময়,
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।
গেটনোট একটি প্লাটফরম যা চাকরির পরীক্ষাসহ অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আপনাকে একধাপ এগিয়ে থাকতে আপনার সহায়ক হবে। আপনার প্রস্তুতিকে করে তুলবে আরও শাণিত। বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেলেই আমরা বাজারে নতুন মলাটে কিছু পুরানো বই দেখতে পাই....
© ২০১৯-২০২০ সর্বস্বত্ত সংরক্ষিত NxtOrb দ্বারা।
গেটনোট একটি প্লাটফরম যা চাকরির পরীক্ষাসহ অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আপনাকে একধাপ এগিয়ে থাকতে আপনার সহায়ক হবে। আপনার প্রস্তুতিকে করে তুলবে আরও শাণিত। বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেলেই আমরা বাজারে নতুন মলাটে কিছু পুরানো বই দেখতে পাই....
© ২০১৯-২০২০ সর্বস্বত্ত সংরক্ষিত NxtOrb দ্বারা।